ব্রেকিং নিউজঃ |
মানবজমিন: ২০২৫ সালে এসে আমরা যেন আবার ১৯৭৯-এর ছায়ায় ফিরে যাচ্ছি। মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে গোলা-বারুদের ধোঁয়া, তেহরান-ইসরাইলে সাইরেনের শব্দ, ইসরাইলের আকাশে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কার্যত ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। খামেনিও পাল্টা হুমকি দিয়েছেন। তিনিও আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ‘যুদ্ধ শুরু’র ঘোষণা দিয়েছেন। বৃটেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান উড়িয়ে আনা হচ্ছে। ভূমধ্যসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ নিমিটজ। জি-৭ সম্মেলন থেকে তড়িঘড়ি করে ট্রাম্প দেশে ফিরেছেন। জরুরি সভা করছেন। হোয়াইট হাউস অস্বস্তিকর নীরবতায়। ইরানের ফোর্দোতে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনার দিকে চোখ তাদের।
এই স্থাপনা একটি বিশাল পাহাড়ের নিচে, ভূগর্ভের অনেক গভীরে। সেটা ধ্বংস করতে হলে কমপক্ষে ১৩,৬০০ কিলোগ্রাম ওজনের বোমা প্রয়োজন। এই বোমা বহন করতে পারে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্টিলথ যুদ্ধবিমান। এক্ষেত্রে ইসরাইলকে সফল হতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা লাগবেই। কিন্তু ট্রাম্প কি তার দেশের কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারেন? এ নিয়ে আছে বিস্তর বিতর্ক। যদি তিনি এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন তবে এই যুদ্ধ কি কেবল আধুনিক পারমাণবিক শঙ্কার প্রতিফলন ঘটাবে? নাকি এটি সেই দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত প্রতিশোধ হবে? মনে আছে সেই ১৯৭৯ সালের কথা। তখন মার্কিনপন্থি ইরানের শাসক রেজা শাহ পাহলভিকে উৎখাত করে ইরানের ইসলামিক বিপ্লব।
এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুলুল্লাহ খামেনি। ওই আন্দোলনে শাহ শাসনের অবসানে রাজধানী তেহরানে অবস্থিত তখনকার মার্কিন দূতাবাসে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ইরানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই যুক্তরাষ্ট্রের। বিশ্বমোড়ল হওয়ার পরও ইরানে তাদের সেই গ্লানি আজও বহন করে বেড়াতে হচ্ছে। ওই সময় থেকে ইরানে যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তারাই ইসলামি বিপ্লবের উত্তরাধিকারী। এই শাসনযন্ত্র আজও যুক্তরাষ্ট্রের গলায় কাঁটা হয়ে আছে? পারমাণবিক ইস্যুতে যতটা না, তার চেয়ে বেশি এই অপমানের প্রতিশোধ নেয়া। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে সেই সুযোগ খুঁজছে।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা কোথা থেকে শুরু?
আরও গভীরে গিয়ে বলা যায়, ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ১৯৫৩ সাল থেকেই উত্তাল। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন যৌথভাবে এক ‘সিআইএ-পৃষ্ঠপোষক’ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে সরিয়ে দেয়। কারণ? মোসাদ্দেক ইরানের তেল জাতীয়করণ করেছিলেন। এটা ছিল পশ্চিমা শক্তির জন্য অর্থনৈতিক আঘাত। এ জন্য তারা ইরানের তেল সম্পদকে লুটেপুটে খেতে পারছিল না। এরপর যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির রাজত্বে ইরান পশ্চিমঘেঁষা এক শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয়। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব সেই রাজনীতি উল্টে দেয়। আয়াতুল্লাহ রুহুলুল্লাহ খোমেনি নেতৃত্বে একটি ধর্মভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই শাসনব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রকে ঘোষণা করে ‘শয়তানের রাষ্ট্র’। এরপর থেকেই দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক কখনওই স্বাভাবিক হয়নি।
ইসলামিক বিপ্লবের প্রতিশোধের রাজনীতি
ইরানের বর্তমান নেতৃত্ব— বিশেষ করে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি— বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, তারা শুধুই একটি রাষ্ট্র নয়, বরং একটি ‘বিপ্লবী আদর্শ’। সেই আদর্শ যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধিতা ও জায়নিস্টদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানেই প্রশ্ন উঠে: আজকের যুদ্ধ কি আসলে সেই ১৯৭৯ সালের প্রতিক্রিয়া? খামেনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে বার্তাগুলো দিচ্ছেন (যুদ্ধ শুরু হয়েছে, জায়নিস্টদের কোনও দয়া করা হবে না)— তা শুধু প্রতিক্রিয়া নয়, বরং একটি বিপ্লবী চেতনার ধারাবাহিক প্রতিফলন। তাদের চোখে যুক্তরাষ্ট্র এখনও সেই ‘সাম্রাজ্যবাদী দানব’। তারা মুসলিম বিশ্বের শোষণকারী। এই দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও সামরিক পদক্ষেপকে দেখা হয় ‘ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে, যা ইরানকে আদর্শিকভাবে আরও প্রতিরোধী করে তোলে।
পারমাণবিক অস্ত্র: বাস্তব হুমকি, না কৌশলগত গুজব?
২০০০-এর দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দুতে। যুক্তরাষ্ট্র বহুবার দাবি করেছে যে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। ইরান অবশ্য বলে আসছে, তাদের প্রকল্প শুধু শান্তিপূর্ণ ও গবেষণাভিত্তিক। ২০১৫ সালের জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্লানক অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) চুক্তিতে ইরান আন্তর্জাতিক তদারকির বিনিময়ে তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত রাখতে রাজি হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর ইরান ধীরে ধীরে চুক্তির শর্ত ভাঙতে থাকে, যা আবারও উদ্বেগ তৈরি করে। ২০২৫ সালে এসে গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে— ইরান সম্ভবত ‘নিউক্লিয়ার ব্রেকআউট ক্যাপাবিলিটিতে’ পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ তারা খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম। এই তথ্য যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক হস্তক্ষেপের একটি ন্যায্যতা দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতি: শুধু ইসরাইল বনাম ইরান নয়
২০২৫ সালের মে-জুন মাসে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময় শুরু হয়। একদিকে ইসরাইল দাবি করছে তারা ইরানের একটি গোপন ইউরেনিয়াম স্থাপনা ধ্বংস করেছে। অন্যদিকে ইরান বলছে তারা ‘ফাত্তাহ’ নামের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরাইলকে প্রত্যাঘাত করেছে। তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস করে দিয়েছে। তেলক্ষেত্রে আঘাত করেছে। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে তেল আবিবের বহু স্থাপনা। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলেন, আমরা জানি ‘সুপ্রিম লিডার’ কোথায় আছেন। আমরা চাইলে তাঁকে এখনই সরাতে পারি। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বৃটেনের লেকেনহিথ ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেছে। এটা যুদ্ধ প্রস্তুতির স্পষ্ট ইঙ্গিত। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে— যুক্তরাষ্ট্র কি শুধু ইসরাইলের পক্ষ নিচ্ছে, না কি নিজেই একটি সামরিক সংঘাতে প্রবেশ করছে?
কংগ্রেস বনাম হোয়াইট হাউস: আইনি দ্বন্দ্ব
মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী, যুদ্ধ ঘোষণা করার অধিকার কেবল কংগ্রেসের। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হলেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই সীমিত সামরিক অভিযান চালাতে পারেন। ট্রাম্প অতীতে সিরিয়ায় এমন হামলা চালিয়েছিলেন। বর্তমানে কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্য থমাস ম্যাসি বলেছেন— এটা আমাদের যুদ্ধ নয়। হলেও কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তবে সামরিক প্রস্তুতি ও ট্রাম্পের ঘন ঘন হুমকি এটাই বলে দেয় যে, কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
অর্থনীতি ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা
যুদ্ধের আরেকটি বড় দিক হলো অর্থনৈতিক চাপ। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর দীর্ঘদিন ধরে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। পারমাণবিক অস্ত্রের দোহাই দিয়ে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কৌশল কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় মিত্রদের সাথে চুক্তিতে ফিরতে পারেনি। তুরস্ক, চীন, রাশিয়া— সবাই এখন ইরানের পাশে কোনো না কোনোভাবে অবস্থান নিয়েছে। ফলে ইরানকে কূটনৈতিকভাবে চাপে ফেলার চেষ্টাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখানে উল্লেখ্য, এ কয়েকদিনে চীন কূটনৈতিক ভাষায় প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবার সরাসরি মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিরোধিতা করি।
ইসলাম বনাম পশ্চিম: আদর্শিক সংঘর্ষের পুনর্জাগরণ?
এই যুদ্ধকে শুধু রাজনৈতিক বা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ভুল হবে। খামেনি ও তাঁর অনুসারীরা একে ‘ইসলামের পবিত্র যুদ্ধ’ হিসেবে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ‘পশ্চিমা শয়তানি জোট’ হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। এই বার্তাগুলো মধ্যপ্রাচ্যের বহু তরুণের মধ্যে সহানুভূতির সৃষ্টি করছে, বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে। ফলে এই যুদ্ধ কেবল ইরান-যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং মুসলিম বিশ্ব বনাম পশ্চিমাদের মধ্যকার একটি আদর্শিক সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। এই যুদ্ধ কোথায় নিয়ে যেতে পারে?
এই যুদ্ধ আসলে একইসাথে তিনটি মাত্রা বহন করছে।
১. ইতিহাসের প্রতিশোধ: ১৯৭৯-এর বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া ও সিআইএ-সমর্থিত অতীতের অভ্যুত্থানের ক্ষোভ
২. পারমাণবিক আতঙ্ক: নিরাপত্তা ও সামরিক প্রভাব বজায় রাখতে চাওয়া দুই পক্ষের ভয়াবহ অস্ত্র প্রতিযোগিতা
৩. আদর্শিক দ্বন্দ্ব: ইসলাম বনাম পশ্চিমের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ
এই সংঘাতের ভয়াবহতা কেবল আঞ্চলিক নয়, বরং বৈশ্বিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। একদিকে যদি পারমাণবিক হামলার ঝুঁকি থেকে থাকে, অন্যদিকে রয়েছে কোটি মানুষের বিশ্বাস, আত্মপরিচয় ও ইতিহাসের বেদনার স্পর্শ। যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় পরিস্থিতি তাহলে মধ্যপ্রাচ্য ছারখার হয়ে যেতে পারে। এর উত্তাপ আরও ছড়িয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপ নিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ববাসী তিল তিল করে গড়ে তুলেছে আজকের বিশ্ব। তখনকার সময় থেকে এখন পৃথিবী রয়েছে ‘ই-যুগে’। বুর্জ খলিফা, মালয়েশিয়ার টুইন টাওয়ার, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার সহ অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন সমৃদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে। এখন যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তাহলে তা পৃথিবীকে আবার নিয়ে যাবে সেই অন্ধকার অতীতে। তাই এখন সময় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার, যুদ্ধের পরিবর্তে কূটনীতিকে প্রাধান্য দেওয়ার। নয়তো, ২০২৫-এর এই যুদ্ধ হতে পারে এমন এক আগুন, যা গোটা মানবসভ্যতাকে ঝলসে দিতে পারে।
সংবাদটি পঠিতঃ ১৪ বার