
নব আলো : বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে আছে দেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর কোনো দেশই ভূমিকম্পের ঝুঁকিমুক্ত নয়। তবে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি।
একই কারণে রাজধানী ঢাকা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে রিখটার স্কেলে সাড়ে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা যদি হয়, তাহলে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে ঢাকা হবে কংক্রিকেটর স্তূপ। কারণ, ৭০ শতাংশ বহুতল ভবনই ভূমিকম্পসহনীয় নয়। এতে করে ধসে যেতে পারে ৭২ হাজার ভবন। বিশেষজ্ঞ এবং নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকায় অনিয়ন্ত্রিত, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও বিপজ্জনক গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগের কারণে বড় ভূমিকম্পে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকার ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবেলায় আরও তিন বছর আগে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একাধিক প্রকল্প নিলেও সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীরগতিতে। এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও যথার্থতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। অবশ্য গণপূর্ত মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম সমকালকে বলেছেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিরসনে বহুতল ভবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এরপর চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি যে কারণে :যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ কেভিন ক্রাজিকের নিবন্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্প ঝুঁকির তালিকায় বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে। নিবন্ধে বাংলাদেশ অংশে তিনি লিখেছেন, উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে দেশের মধ্যবর্তী অংশের মধ্য দিয়ে উত্তর দিকে ভূমির গভীরে বহুদিন আগে বিলীন হয়ে যাওয়া একটি ‘ফল্টস’ আবারও সক্রিয় হচ্ছে।
এটি বর্তমানে শক্তি সঞ্চয়ের অবস্থায় রয়েছে। একটি সময় পরে সঞ্চিত শক্তি উন্মুক্ত হতে শুরু করলে তখন যে কোনো মুহূর্তে ভয়াবহ ভূমিকম্প হতে পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম নদী অববাহিকা ও সমুদ্র উচ্চতার খুব কাছাকাছি হওয়ায় সুনামির হুমকিতেও রয়েছে। বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে একদিকে যেমন অবিন্যস্ত বহুতল ভবনগুলো ধসে পড়বে, অন্যদিকে নদীগুলোর গতিপথে পাল্টে যেতে পারে। এতে করে ভূমি বিন্যাসেও বড় পরিবর্তন ঘটতে পারে।
কেভিন ক্রাজিকের এই মতামতের বিষয়ে জানতে চাইলে আবহাওয়া দপ্তরে ভূমিকম্পের কেন্দ্র নির্ণয়ের দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞ মমিনুল হক সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরোশীয় ও বার্মা এই তিন গতিশীল বা সম্প্রসারণশীল আন্তঃমহাদেশীয় প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে ইউরোশীয় প্লেটের মধ্যে আছে নেপাল। সেখানে ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশ কেঁপে ওঠে। তবে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল অনেক দূরে হওয়ায় এর প্রবল প্রভাব পড়ে না। অন্যদিকে, ভারতীয় প্লেটের মধ্যে আসাম সীমান্তে ভূমিকম্প হলে তার প্রভাব বড় আকারে হতে পারে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের সিলেট অঞ্চলে ডাউকি ফল্টের অবস্থান ঢাকা থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরে। আর বার্মা ফল্টের অবস্থান চট্টগ্রামের কাছে পাহাড়ি অঞ্চলে।
ভূমিকম্পের ইতিহাসে দেখা যায়, ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক’ নামে যে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প হয়েছিল তার কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতীয় বেল্টে ভারতের শিলং অঞ্চলে। এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৫। এর ফলে ঢাকায় অনেক ভবন বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং বহু মানুষ হতাহত হয়েছিল। একইসঙ্গে এই এলাকার একাধিক নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় ভূমি বিন্যাসেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল।
তারপর ১৯১৮ সালের ৮ জুলাই ডাউকি ফল্টের ভেতরে একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরে শ্রীমঙ্গলে এবং রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬। এ ভূমিকম্পেও ঢাকায় বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এ ছাড়া ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে মধুপুর ফল্ট থেকে সিরাজগঞ্জ এলাকায় একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, যার মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৫।
মমিনুল হক বলেন, ১৯১৮ সালের পর ঢাকার খুব কাছাকাছি কেন্দ্রস্থলের মধ্যে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প হয়নি। এখন যে সময়টা যাচ্ছে সেটা আসলে গতিশীল প্লেটের শক্তি সঞ্চয়ের সময়। সঞ্চিত শক্তি যখনই উন্মুক্ত হওয়া শুরু করবে তখনই বড় মাত্রায় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তবে কতদিন শক্তি সঞ্চিত হতে থাকবে আর কবে উন্মুক্ত হবে, তা কোনো প্রযুক্তি দিয়ে কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, কেভিন ক্রাজিক তার নিবন্ধে যে আশঙ্কা করেছেন তা অনেকটা অতিরঞ্জিত। কারণ, তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী বাংলাদেশের মাঝ বরাবর কোনো ফল্ট চলে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায় না। বরং দুই দিকে দুটি ফল্ট আছে। তা ছাড়া বঙ্গোপসাগারের তলদেশ অপেক্ষাকৃত কম গভীর হওয়ায় এবং সমুদ্রসীমার খুব কাছে মহীসোপান থাকায় এ অঞ্চলে সুনামির আশঙ্কাও অনেক কম। মহীসোপান সুনামি প্রতিরোধে খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে। তাই বলে বাংলাদেশ ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে নেই- এটা বলা যাবে না।
বড় ভূমিকম্পে লণ্ডভণ্ড হবে ঢাকা :নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবীব দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বহুতল ভবন নির্মাণসংক্রান্ত ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করছেন। ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করার নাগরিক আন্দোলনেও সক্রিয় রয়েছেন। তিনি সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে আছে- এটি একাধিক গবেষণা থেকে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এ ধরনের ঝুঁকিতে যে সব দেশ থাকে, সেসব দেশকে ঝুঁকি মোকাবেলায় অনেক বেশি সচেতন থাকতে হয় বহুতল ভবন নির্মাণ এবং নগর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকার ক্ষেত্রে এটি একেবারেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, এখন যদি ঢাকা বড় মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তাহলে তিনটি বড় বিপর্যয় ঘটবে। প্রথমত, ঢাকার অবিন্যস্ত, অপরিকল্পিত ও অপরিবীক্ষণকৃত ভবনগুলো বিধ্বস্ত হবে। রাজউক ও বুয়েটের গবেষণায় দেখা গেছে, রাজউকের এলাকায় থাকা ১২ লাখ এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের এলাকায় থাকা প্রায় চার লাখ ভবনের ৭০ শতাংশই ভূমিকম্প সহনীয় নয়। অর্থাৎ বড় মাত্রায় ভূমিকম্প হলে এগুলো বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। এর অর্থ বড় ভূমিকম্প হলে মুহূর্তেই ঢাকা কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হবে।
দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ ভবনে যে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে, তার নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। এর আগে ঢাকায় ভূমিকম্প হওয়ার ফলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গ্যাস সংযোগে স্বয়ংক্রিয় সার্কিট ব্রেকার প্রযুক্তি ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছিল। এই প্রযুক্তিতে নির্ধারিত মাত্রার বেশি ভূ-কম্পন অনুভূত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে গ্যাস সংযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। তবে পরবর্তীকালে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। এর ফলে এখন যেভাবে গ্যাস সংযোগ রয়েছে ভূমিকম্প হলে এই গ্যাস লাইন থেকেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। একইসঙ্গে যেভাবে বিপজ্জনক বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে এবং ভবনের ভেতরে মানসম্পন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নিশ্চয়তা বিধানের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বড় আকারে ভূমিকম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। তখন পরিণতি কী ভয়াবহ হবে। প্রাণ হারাবে অসংখ্য মানুষ। উদ্ধার কাজের জন্য যত ভালো যন্ত্রপাতিই কিনে রাখা হোক বহুমুখী বিপর্যয়ের সময় সেগুলো খুব বেশি কাজে আসবে না।
স্থপতি ইকবাল হাবীব আরও বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় ভবন নির্মাণের পর তা যথাযথভাবে নির্মিত হয়েছে কি না, সেটি পরীক্ষার পাশাপাশি ভূমিকম্প সহনীয়তা, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, গ্যাস সংযোগসহ নিরাপত্তার কয়েকটি বিষয় পরিবীক্ষণ করে ‘অকুপেন্সি সার্টিফিকেট’ দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে রাজউক এই অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের বিষয়টি বাধ্যতামূলক না করে ঐচ্ছিক করে ফেলে। এর ফলে ২০০৮ সালের পর নির্মিত প্রায় ৪০ হাজার ভবনের মধ্যে মাত্র ১৬৫টি ভবন অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিয়েছে, আর কেউ নেয়নি।
এর অর্থ এই ১৬৫টি ভবন ছাড়া অন্য সব ভবন অপরিবীক্ষণকৃত এবং নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি। এখনও সময় আছে সরকারের উচিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে তাদের মাধ্যমে রাজধানীর সব ভবন পরিদর্শন করানো। চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ঝুঁকি নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া অথবা ভবনগুলোতে ‘বিপজ্জনক’ সাইন বোর্ড টানিয়ে দেওয়া। তথ্য : সমকাল ।