
আজ এই অবুঝ শিশু দু‘টির কথা খুব মনে পড়ছে। রাতে আমি খবরটি শুনে কিছুক্ষন নিস্তব্ধ হয়ে যাই। চোখের সামনে ভেসে ওঠে মরহুম সাংবাদিক সোহানুর রহমান সোহানের ছোট ছেলে দু‘টির মুখ। ওরা এখন কোথায় যাবে, কী নিয়ে বাঁচবে? পৃথিবীর সব চেয়ে প্রিয়, সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বাবা-মাকে হারালো ওরা। অল্প সময়ের ব্যবধানে বাবা ও মা’ দু‘জনই ওদের ছেড়ে বিদায় নিল। দেড় বছর আগে ইন্তেকাল করেন সোহান। আর সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়ে আজ রাতে মারা গেলে ওদের মা ইয়াসমিন আক্তার নদী।
কিছুদিন আগে সোহানের স্ত্রী নদী সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। নারায়নগঞ্জের বন্দর থানার মদনপুরে স্বামীর ক্রয় করা সম্পত্তি দখল নিতে গিয়ে আপন বড় ভাই মাদক ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম পারভেজ তার দলবলসহ ছোট বোন (সোহানের স্ত্রী) নদীর (৩২) ওপর হামলা চালায়। কোদাল দিয়ে নদীর মাথায় আঘাত করে। শাবল দিয়ে পিটিয়ে কোমড়ের হাড় ভেঙ্গে দেয়।
এ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে বাড়িতে নেয়া হয় নদীকে। সেখানে ফের অসুস্থ হয়ে পড়ে। ৫ এপ্রিল তাকে নারায়নগঞ্জের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ (০৬.০৪.২০১৯) রাত পৌনে ৯টার দিকে ইন্তেকাল করেন নদী।
এর আগে ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন সোহান । তিনি বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন (ক্র্যাব) এর সদস্য ও এনটিভির স্টাফ রিপোর্টার (ক্রাইম ওয়াচ) ছিলেন।
সোহানের মৃত্যুর পর ছেলে দু‘টি নিয়ে কোনো রকম একটু বেঁচে থাকাতে জীবনযুদ্ধে নেমে ছিলেন নদী। সন্তান দু‘টিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন দিনের। স্বামীর ক্রয়করা জমিতে বন্দর থানার মদনপুরে কোনো রকম ঠাঁই নিয়ে ছিলেন। সেখানে চার শতাংশ জমি দখল করে ছিল নদীর বড় ভাই সন্ত্রাসী পারভেজ। দুই সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে বড় ভাইয়ের দখল থেকে সেই জমি বুঝে নিতে গিয়েছিলেন নদী। সেখানেই গত ১৩ মার্চ নদীর ওপর নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্বৃত্তরা। ২৪ দিনের মাথায় মৃত্যু হলো তার ।
সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো- এ ঘটনায় নদীর ছোট ভাই তরুন মিয়া বাদী হয়ে বন্দর থানায় একটি মামলা করেছিলেন। পারভেজসহ চারজনকে আসামী করা হয়। এই মামলার একজন আসামীকেও পুলিশ আটক করেনি। একটি সাংবাদিক পরিবারকে এভাবে নি:শেষ করে দেয়ার ঘটনাটি যেনো স্বাভাবিক ব্যাপার। যেখানে জোরে শব্দ করলেও কারো পালিয়ে থাকার উপায় নেই। ঠুনকো ঘটনায়ও কোমড়ে রশি বেঁধে ধরে আনা হয় । সেখানে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীদের দিয়ে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হলেও আসামী গ্রেফতার হয় না! হত্যা চেষ্টা/হত্যা মামলার আসামীদের ২৪ দিনেও পুলিশ আটক করতে পারেনি! সোহানের শ্যালক তরুন মিয়া জানান, পুলিশ নাকি বাড়িতে গিয়ে ঘুরে গেছে। পুলিশ বলছে-আদালত থেকে জামিন নিয়েছে আসামী।
(সিনিয়র সাংবাদিক নাছির উদ্দিন শোয়েবের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)
এদিকে ফেসবুক স্ট্যাটাসটিতে মরহুম সোহানের সহকর্মী, বন্ধু ও শুভাকাঙ্খি ছাড়াও অনেকে মন্তব্য করেছেন। সেখান থেকে কয়েকটি তুলে ধরা হলো ---
সিনিয়র সাংবাদিক ফকরুল আলম কাঞ্চন লিখছেন, চোখের সামনেই সব তছনছ হয়ে গেলে । হে আল্লাহ তুমি এতিম শিশু দুটির জিম্মাদারী নেও
সিনিয়র সাংবাদিক লিটন হায়দার লিখছেন, কিছু করার নেই।৷ মহান সৃষ্টি কর্তা রাব্বুল আলামীন যেটা ভাল মনে করেছেন সেটাই করেছেন। আল্লাহ তাদের জান্নাতবাসী করুন।।।
সিনিয়র সাংবাদিক কাফি কামাল লিখছেন, আল্লাহ বাচ্চা দুটোর সহায় হোন।
আত্মীয়-স্বজনরা বাচ্চা দুটোর প্রতি দরদি হোন। ক্ষমা করবেন, সেইসঙ্গে সাংবাদিকরা পেশাগত কল্যান বা পেশাজীবীদের কল্যান চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে ভূমিকা আরো জোরদার করুন।
সিনিয়র সাংবাদিক জামিউল আহসান শিপু লিখছেন, সোহান ভাই বেঁচে থাকার সময় এক শ্রেণীর ক্রাইম রিপোর্টার তার সম্পর্কের প্রচার করতেন যে, তিনি অঢেল টাকার মালিক। ক্র্যাবের নির্বাচন এলে তার সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হতো। ২০১২ সালে ক্র্যাবের নির্বাচনের সময় এনটিভির শফিক শাহীন ভাইয়ের মাধ্যমে সোহান ভাইয়ের সঙ্গে ক্লোজলি জানাশোনা শুরু হয়। এরপর থেকে তার সম্পর্কে ধারনা পাল্টাতে থাকে। তার অভাব অনটন থাকলেও তিনি কখনও মুখ ফুটে কাউকে বলতেন না। অন্য সাংবাদিকরা তার সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বললে, তিনি খুব মজা পেতেন। তার অঢেল সম্পদ আছে বা তার স্ত্রীর অঢেল সম্পদ আছে-এরকম বানানো গল্প শুনে তিনি মাঝে মধ্যে হো হো করে হাসতেন। ২০১৫ সাল থেকে কাওরানবাজারে ইত্তেফাক অফিসের সামনে চায়ের দোকানে তার সঙ্গে নিয়মিত দেখা হতো। মজার বিষয় হলো, ব্যক্তি জীবনে সোহান ভাই মদ তো দূরে থাক, সিগারেট পর্যন্ত খেতেন না। অথচ তাকে নিয়ে ক্রাইম রিপোর্টাররা কত আসরের গল্প করতেন-ভাবতেই মনে হয়, নির্বাচন হলে আমরা কত কাদা ছোঁড়াছুরি করতে পারি! যাই হোক, সোহান ভাইয়ের মৃত্যুটা আমি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারিনি। আমার ধারণা, ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছিল।
কিন্তু তার স্ত্রীর ওপর যে নির্যাতন করে চির বিদায় দেয়া হলো-এর দায়ভার কী আমাদের ক্রাইম রিপোর্টারদের ওপর পড়ে না?
সাংবাদিক আতাউর রহমান কাবুল লিখছেন, আপনারা ক্রাইম রিপোর্টাররা সন্তানদের পাশে দাড়ান আর অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে সিরিয়াস হোন
নাবিহা তাহসিননামে একজনে লিখছেন, সোহানকে অনেক সহকর্মীই অন্য চোখে দেখতো। ব্যক্তি জীবনে সোহান কতুটুকু মন্দ বা ভাল ছিল কাছের ব্যক্তিরা ছাড়া কেউ জানবে না। উপরে উপরে সোহান নিজেকে অর্থসম্পদওয়ালা প্রকাশ করলেও প্রকৃতপক্ষে ওর তেমন কিছুই নেই, যার প্রমান এতদিনে হয়তো জানাও গেছে। ওর অকাল মৃত্যুটা পরিবারে হঠাৎ ঝড় বয়ে যাওয়ার মতো। পরিবারের জন্য ও কিছুই রেখে যেতে পারেনি। মাত্র ৪ শতাংশ জমি রেখে গেছে, সেটুকুও ভোগ করতে পারেনি ওর পরিবার। আর এ কারণে স্বামীর মৃত্যুর দেড় বছরের মাথায় খুন হতে হলে সোহানের স্ত্রীকে। আল্লাহ সোহানের এতিম ছোট্ট দু‘টি বাচ্চার জন্য সহায় হউন। আমিন।
মোহাম্মদ আবুল হোসাইন নামে অন্য একজনে লিখছেন, হায়! আমার ছোট বাচ্চাটাও তো দেখতে ঠিক ওদের মত! এত ছোট বাচ্চাদের এই অসহায় অবস্থা সহ্য করা যায় না।আল্লাহ তুমি ওদের জন্য একটা পথ করে দাও!
কামরুল হাসান নামে অপর একজনে লিখছেন, কি বলবো বুঝতে পারছি না। কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করছি। সবাই যার যার ক্ষুদ্র জায়গা থেকে এগিয়ে আসলে অনেক কিছু করা সম্ভব।